বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১১

ফতোয়ার খঁড়গ

খবরটা শুনে একাব্বর মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

- 'ইশশ্‌! দ্যাশের বড় আদালত একদিন আগে যদি এইরাম একখান রায় দিত, তাইলে একমাত্র দুধের গাইটা আর বেচতে অইত না।' খেদোক্তি করে উঠে একাব্বর- 'ম-রা, খালে যখন নামলি, লুঙ্গি ভিজায়া নামলি ক্যান? আর লুঙ্গি যখন ভিজাইলি, ন্যাংটা অইলি ক্যান?'

গৃহস্থালী সংসার একাব্বরের। পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত জমি-জিরাত যাই আছে, খেয়েদেয়ে কোন রকম চলে যায়। স্বচ্ছলতার অংকে সুখে না থাকলেও অসুখী বলা যায় না একাব্বর মিয়াকে। শুধুমাত্র একটি সন্তানের আশায় মনের মধ্যে অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ খচ্‌খচ্‌ করে সব সময়। সন্তান দানে ব্যর্থ বাঁজা মাগিটাকে বহু বুদ্ধি করে খেঁদিয়েছিল একাব্বর। বিয়ের পনর বছরের মধ্যে যে একটি সন্তান দিতে পারেনি, এ সংসারে তার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না সে। বাঁজা স্ত্রীকে বিদায় করতে তার বেশী বেগ পেতে হয়নি। বুদ্ধিমান একাব্বর বুদ্ধির জোরে বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে তার ইচ্ছার কথা জানাল। ব্যাস, ফতোয়ার কাফ্‌ফারা পেয়ে ইমাম সাহেব একাব্বর আর তাঁর স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলাহীন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিল। বিদায় হল আপদটা।

সঙ্গীহীন পশুও এই সমাজে বেমানান। আর সেতো জলজ্যান্ত মানুষ। রাতে ঘুমাতে গেলে সারা শরীরের রক্তের উষ্ণতা যখন জমাট বেঁধে নিম্নগামী হয়ে বিশেষ অঙ্গে হিস্‌হিস্‌ জাগায়, তখন বড়ই বিচলিত বোধ করে একাব্বর। এদিকে বংশের প্রদীপের প্রয়োজনীয়তা মূখ্য হয়ে উঠে। একমাসের মাথায় এক চপলা তন্বী ষোড়শীকে বধু করে ঘরে উঠায় একাব্বর।
বিধিবাম! একি হল একাব্বরের!! ষোড়শীর উষ্ণ রক্তের চপলতায় প্রতিদিন খেঁই হারিয়ে ফেলে সে। নতুন বধুর উষ্ণতা এতই তীব্র, এ যেন আজন্ম শীতল হওয়ার নয়। মাঝ দরিয়ায় প্রতিদিন হাবুডুব খেতে খেতে ক্লান্ত একাব্বর। বধুর অতৃপ্তির গোদ্‌গোদ্‌ 'লু' হাওয়া বয়ে যায় দিনভর একাব্বরের উপর দিয়ে। প্রতিদিনের এই অতৃপ্তির খেঁদ বিন্দু বিন্দু দাঁনা বেঁধে সিন্ধূতে পরিণত হতে থাকে।

'বুড়া ভাম! মাটি কাঁটতি জানিস নাতো, কোঁদাল ধরিস ক্যান'? প্রতিদিনকার বউয়ের তাচ্ছিল্য ভরা এই উক্তিটা যেন একাব্বরের পৌরষত্বকে নিদারুন উপহাস করে। তারপরও নিজের অক্ষমতায় বউয়ের উপহাসকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে সে। তার প্রয়োজন বংশের আলো।

ভেবে পায়না একাব্বর। প্রদীপে এত তেল ভরে সে, কিন্ত সলতে ভিজে না কেন? তবে কি তারই অক্ষমতা। এ বড়ই কষ্টের অনুভুতি। অব্যক্তেয় কষ্টে তার বুকটা সারাক্ষণ খচ্‌খচ্‌ করে। কষ্টের ভোতা অনুভূতি নিয়ে সলতে ভেজার অপেক্ষায় দিন গুনছে একাব্বর। এই অপেক্ষার কাছে বউয়ের 'মাটি কাটা, কোঁদাল ধরতে না পারা'র উপহাসকে সে ম্লান করে রাখে; স্বেচ্ছায়, অবলীলায়।

ঘটনার জট লাগে অন্যখানে। বউ তার অতৃপ্তের বাসনার সলিল রচনা করতে চায় তারই আপন ভাইপো'র সাথে, যে কিনা তাঁর বউয়ের প্রায় সমবয়সী। একাব্বরকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভাইপো'র সাথে বালখিল্যতা, আদিখ্যেপনা। বউয়ের হাঁসাহাঁসি, মাতামাতি বড়ই নিষ্ঠুর ঠেকে। হয়তঃ ভাইপো'র মনে নেই কোন হারামীপনা। কিন্তু ভাইপো'র সাথে বউয়ের এই লাস্যময়ী আচরণ শুধু একাব্বর বা তার পৌরষত্বকে উপহাস করছে না। সমাজকেও জানান দিচ্ছে তাঁর কোঁদাল ধরতে না পারার ইতিকথা। বউয়ের এ কাহিনী চাওর হতে থাকে আকাশে বাতাসে। এ বড়ই অপমানের, বড়ই লজ্জ্বার।

সহ্যের সীমা যখন অনতিক্রম্য পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যায়, একাব্বর চুড়ান্ত স্বিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলে। আগের ন্যয় বুদ্ধি খাঁটিয়ে আপদ বিদায় করার মানসে ফতোয়ার শানধার খঁড়গটির দ্বারস্থ হতে একাব্বর যায় বড় হুজুরের কাছে।

কিন্তু একি শোনাল বড় হুজুর! সরকারের সদ্য করা নারীনীতির কারণে হুজুরের ফতোয়ার খঁড়গটির শান নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। ভোতা এই খঁড়গে একাব্বরের বাসনা পুরণ হওয়ার নয়। অনেক বলে কয়েও হুজুরকে সে রাজী করাতে পারল না। ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজটি না করে হুজুর জেলা শহরে একজন উকিলের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতের সরাণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিল। এ অনেক খরচের ব্যাপার। সমাধানের পথও আবার দীর্ঘ।

হোক খরচ। তারপরও দিনকে দিন এই জোয়ান মাগীটার বেহাল্লাপনা একাব্বর সহ্য করতে পারছিল না। জমির ফসল ঘরে না উঠার কারণে হাতেও নগদ নেই। অনুন্যপায় হয়ে তাঁর দুগ্ধবতী গাভিটি বিক্রি করে আগুন যৌবনা রাক্ষুসীটাকে বিদায় করার মনস্থির করল।

একাব্বর ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে যখন গাভি বিক্রির টাকাগুলো গুনছিল, তখনি দ্যাশের বড় আদালতের ফতোয়া জায়েজ করার খবরটা পেল। খবরটি পেয়ে গাভি হাঁরানোর দুঃখে মাথায় হাত দিয়ে বসে উপরের খেঁদোক্তিগুলো করলেও, মনে মনে সে খুশী। যাক মাগীটাতে অল্পতেই বিদায় করা যাবে।

- 'রাইতেই বড় হুজুরের ফতোয়ার ছেনিটার ধার দেইখা আসতে অইব' - একাব্বরের আহাল্লাদ ভরা স্বগোক্তি।

অনুগল্প
১৫/০৫/২০১১
ঢাকা
নাগরিক ব্লগে প্রথম প্রকাশিত।